রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫, ০৭:৪৭ অপরাহ্ন

এই গ্রহ কি নিরাপদ রাখা যাবে?

এই গ্রহ কি নিরাপদ রাখা যাবে?

মুঈদ রহমান :

আজ ৩১ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো নগরীতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন ‘কপ-২৬’। পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে জাতিসংঘের এ উদ্যোগকে বলা হয় ‘কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিজ’ বা সংক্ষেপে কপ (COP)। ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এটি হলো ২৬তম সম্মেলন। ২০২০ সালে করোনার কারণে সম্মেলন হয়নি। ব্রিটিশ এমপি অশোক শর্মা কপ ২৬-এর প্রেসিডেন্ট। ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বের প্রায় ১৯৭টি দেশের ২৫ হাজারেরও বেশি প্রতিনিধি এ সম্মেলনে অংশ নেবেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন রাজনীতিক, পরিবেশবাদী, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ নানা স্তরের, নানা মতের মানুষ। এ সম্মেলন যখন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তখন আমাদের সামনে জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক কুফল উপস্থিত। বিশেষজ্ঞরা জলবায়ুর এ পরিবর্তনকে করোনাভাইরাসের চেয়েও বিপর্যয়কর মনে করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট এখন দৃশ্যমান। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে কানাডায় ঘটে গেল ইতিহাসের সর্বোচ্চ দাবদাহ। প্রচণ্ড দাবদাহে কানাডায় প্রায় ১০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পশ্চিম ইউরোপের বন্যাও নজিরবিহীন। জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলে রেকর্ড পরিমাণ অতিবৃষ্টি হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে বন্যার। সেই বন্যার প্রকোপে প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক মানুষ। বন্যায় প্লাবিত হয়েছে নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড ও বেলজিয়াম। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, উত্তর আমেরিকার কিছু অঞ্চল, সাইবেরিয়া, ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চল দাবানলে পুড়ে ভস্মে পরিণত হয়েছে। গ্রিস ও আলজেরিয়াতে দাবানলে পুড়েছে শত শত মানুষ। আলজেরিয়ার ১৮টি প্রদেশের ৭০টিরও বেশি জায়গায় এ দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের ১৩৪টি দেশ এখন দাবানলের হুমকির মুখে যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বিশি। ২০২০ সালে পৃথিবীর প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা খরার সম্মুখীন হয়েছে। এর সবই হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে। পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুতহারে বেড়ে চলেছে। ২০১১ সাল থেকে ২০২০-এই এক দশকে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১৮৫০-১৯০০ সালের তুলনায় বেড়েছে ১.০৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত ৫ বছর ছিল বিগত ১৫০ বছরের তুলনায় উষ্ণতম সময়। ১৯০১ সালের তুলনায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার তিনগুণ বেড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে, এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় দুই মিটার বৃদ্ধি পাবে। ফলে ব্যাপক প্লাবনের মুখে পড়তে হবে সমুদ্র অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের। মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। সবকিছু হারিয়ে আশ্রয় নেবে শহরে। বিশেষজ্ঞরা এমন মানুষদের বলে থাকেন জলবায়ু শরণার্থী। এমন জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা বিশ্বে উল্লেখযোগ্য। তাই অনেকে আক্ষেপের সুরেই দাবি করেন যে, যেসব দেশের কারণে আজ এ শরণার্থীর সৃষ্টি, সেসব দেশকেই তাদের আশ্রয় দেওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে কপ-২৬ প্রেসিডেন্ট অশোক শর্মা আশ্বস্ত করে বলেন, ‘আমরা যেটা করতে চাই তা হচ্ছে, মানুষ যাতে তাদের নিজেদের বাড়িতেই থাকতে পারে সে জন্য তাদের সহায়তা করা।’ আমরা সাধারণ বিশ্ব নাগরিকরা ও ভুক্তভোগীরাও তা-ই চাই।

জলবায়ুর পরিবর্তনের মূল কারণ যেহেতু কার্বন নিঃসরণ, তাই বলাই যায় যে, এ সংকটের শুরু শিল্পযুগের সূচনা থেকে। যেসব দেশ যতখানি শিল্পোন্নয়ন ঘটিয়েছে, সেসব দেশ ততখানিই পরিবেশকে দূষিত করেছে। কিন্তু এর কুফলটা ভোগ করছে শিল্পে পিছিয়ে থাকা দেশগুলো। স্বাভাবিকভাবেই এ পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবিলার আর্থিক দায়ভার ধনী দেশগুলোর ওপরই বেশি চাপে। কিন্তু জাতিসংঘের দুঃখজনক তথ্য হলো, প্রতিশ্রুত বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার আদায় করা যায়নি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, যদি পৃথিবীকে ভারসাম্যপূর্ণ কিংবা সহনীয় মাত্রায় রাখতে হয়, তাহলে শিল্পযুগের আগের তাপমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিরিক্ত তাপমাত্রায় রাখতে হবে, এর বেশি নয়। যে কারণে ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে সদস্যভুক্ত সব রাষ্ট্রই পৃথিবীর তাপমাত্রা সহনীয় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এ প্যারিস সম্মেলন থেকেই ঘোষিত হয়েছিল এবং চুক্তিতে সবাই অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল যে, ২০৫০ সাল নাগাদ ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। ফলে প্যারিস সম্মেলনের পরে গ্লাসগো সম্মেলনটি অনেক গুরুত্ব বহন করে। এ সম্মেলনে চারটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথমত, ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতে থাকবে, সেগুলোর হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। তৃতীয়ত, এসব কাজ করার জন্য অর্থের প্রয়োজন। সে জন্য প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনে উন্নত দেশগুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। চতুর্থত, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলা সম্মেলন থেকে আশা করি নতুন কিছু প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার আমরা শুনতে পাব। এ থেকেই বোঝা যাবে আমরা প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নের পথে হাঁটছি কিনা। নতুন প্রতিশ্রুতির মধ্যে থাকতে পারে : এক. ইলেকট্রিক কার বা ব্যাটারিচালিত গাড়ির ব্যবহার দ্রুত বাড়ানো; দুই. কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ থেকে দ্রুত সরে আসা, গাছ কাটার মাত্রা কমানো; তিন. জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আরও মানুষকে রক্ষা করা এবং তার জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা।

আগেই উল্লেখ করেছি, জলবায়ুর এ ক্ষতিকর পরিবর্তনের শুরুটা হয়েছে আঠারো শতকের মধ্যভাগে শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। বর্তমানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি বড় অংশই সম্পাদিত হয় কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে। তাই আমাদের কল্যাণকর কিছু করতে হলে কোনো না কোনো জায়গায় ছাড় দিতে হবে। এর পাশাপাশি মনে রাখতে হবে যে, জলবায়ুর এ অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে হলে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাটা খুব জরুরি। সেক্ষেত্রে কারও না কারও স্বার্থ কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সবার কল্যাণের কথা ভেবে তা মেনে নিতে হবে। এ কথা বলার কারণ হলো একটি রিপোর্টের প্রতিক্রিয়া। গ্লাসগো সম্মেলনকে কেন্দ্র করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার উপায় কী হতে পারে এমন একটি রিপোর্ট তৈরি করেছেন একদল জলবায়ুবিষয়ক বিজ্ঞানী। এ দলটি ৬-৭ বছর পরপর জলবায়ুর কী ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে তার বিচার-বিশ্লেষণ করে থাকে। জাতিসংঘের যে কমিটিতে দলটি কাজ করে তা হলো জলবায়ু সংক্রান্ত আন্তঃসরকার কমিটি বা আইপিসিসি (Intergovernmental Panel on Climate Change)। এবারের রিপোর্টে অন্যতম উপায় হিসাবে তারা মনে করেছেন, বিশ্বে কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনতে হবে। বিশেষ করে কয়লা ব্যবহার বন্ধের জোর সুপারিশ করা হয়। এ রিপোর্ট সম্মেলনে উপস্থাপনের আগেই একাধিক দেশ তা ফাঁস করে দেয় এবং তা পরিবর্তনের জন্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশের সরকার, কোম্পানি ও সংশ্লিষ্টরা সুপারিশকৃত রিপোর্টটি পরিবর্তনের জন্য জাতিসংঘে ৩২ হাজারেরও বেশি প্রস্তাব পেশ করে। উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে আছে-অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত, সৌদি আরব, জাপান, নরওয়ে, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এবং তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক। কেন?

কারণ হলো অস্ট্রেলিয়া ও ভারত হচ্ছে অন্যতম বৃহৎ কয়লা ব্যবহারকারী ও রপ্তানিকারক দেশ। বিজ্ঞানীদের রিপোর্টে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের যে উল্লেখ আছে, তার বিরোধিতা করে অস্ট্রেলিয়া সরকারের এক শীর্ষ কর্মকর্তার ভাষ্য হলো-এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনো আসেনি। ভারতও একই সুরে কথা বলেছে। তাদের কথা হলো, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর কাজটি ভারতের জন্য এখনো চ্যালেঞ্জিং। তাই কমপক্ষে ১০ বছর পর এমনটি ভাবা যাবে। সৌদি আরবসহ তেল উৎপাদনকারীরাও এ রিপোর্টের বিরোধিতা করছে। তাদের কথা হলো, বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন শোষণ করার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হোক। ভারত ও সৌদি আরব মনে করে ‘কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ’ বা সিসিএস নামের এ প্রযুক্তি বায়ুমণ্ডল থেকে নাটকীয় হারে কার্বন শুষে নিতে পারে। প্রতিবেদনের একটি অংশে বলা আছে যে, উদ্ভিদভিত্তিক ডায়েট বা খাবার পশ্চিমা ডায়েটের চেয়ে গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন ৫১ শতাংশ কমাতে পারে। ব্রাজিল এ কথা মানতে নারাজ। কারণ, ২০২০ সালে সারা বিশ্বে ৭টি দেশ ১ বিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি মাংস রপ্তানি করেছে। এ রপ্তানির ২৪ শতাংশই করেছে ব্রাজিল। তাই তাদের বিরোধিতা।

কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এ সম্মেলন হচ্ছে প্রায় ২০০ দেশের সম্মেলন। একই সঙ্গে জলবায়ুর সমস্যাটি সারা বিশ্বের প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের সমস্যা। তাই কোনো রাষ্ট্রের এককভাবে কোনো স্বার্থের কথা বিবেচনায় আনা সমীচীন হবে না। বর্তমানের উন্নয়নের সংজ্ঞা অনেক বেশি প্রসারিত। টেকসই উন্নয়নের মূল কথাই হলো, পরবর্তী প্রজন্মের চাহিদা ও স্বার্থকে নিশ্চিত করে বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা পূরণ। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন পরের প্রজন্মকে নিশ্চয়ই ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে, যা আমরা আশা করতে পারি না। সে ধরনের একটি কার্যকর অঙ্গীকার আমরা গ্লাসগো সম্মেলন থেকে প্রত্যাশা করি।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877